Thursday, November 7, 2024

কিশোরীর পুরো শরীরেই নিপীড়নের চিহ্ন, রেহাই পায়নি দাঁতও, চেষ্টা করা হয় ধর্ষণের

আরও পড়ুন

দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পাশবিক নির্যাতন শিকার হচ্ছেন ১৩ বছর বয়সী এক গৃহকর্মী। কখনও রড, কখনও লাঠি দিয়ে পেটানো হতো, আবার কখনও ছেঁকা দেয়া হতো শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি ভেঙে দেয়া হয়েছে ৪টি দাঁতও।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় ওই কিশোরীকে। বর্তমানে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সরেজমিন ঢামেক হাসপাতালে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন কিশোরীর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল, কোথাও বাদ নেই নিপীড়নের চিহ্নের। রেহাই পায়নি দাঁতগুলোও।

নির্যাতনের শিকার কিশোর জানায়, দীর্ঘ ৫ বছর ধরে চলে তার ওপর এ পাশবিক নির্যাতন। প্রায় প্রত্যেকদিনই রড দিয়ে পেটানো হত। সবশেষ দুদিন আগে হেয়ার স্ট্রেইটনার দিয়ে ছেঁকা দেয়া হয় মুখে। কাজের ভুল ধরে, কখনও মদ্যপ হয়ে চালাতো এই পৈশাচিক বর্বরতা। চিকিৎসার জন্যও কখনও যেতে দেয়া হতো না বাসার বাইরে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নির্যাতনের শিকার মেয়েটিকে আমাদের হাসপাতাল থেকে যতটুকু সাপোর্ট দরকার তার সব টুকুই দেয়া হবে। বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকরা তাকে দেখছেন। এ ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসকরাও তাকে দেখবে।

ঢাকা মেডিকেল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া ক্ষত আছে। মেটাল কোনো জিনিস দিয়ে বিভিন্ন সময় তাকে ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছে। যখন তার চিকিৎসার দরকার ছিল তা পায়নি। নিজে নিজে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেছে। যার ফলে ইনফেকশন হয়ে গেছে। মেয়েটির মুখ থেকে শুরু করে হাত, পা, বুক, পিঠসহ বিভিন্ন জায়গায় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এটা একদিনে করা হয়নি। বিভিন্ন সময় এই কাজ করা হয়েছে। যেটা এখন বিকৃতি হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় শুকিয়ে গেছে কিছু জায়গায় শুকায়নি। তার চারটা দাঁত পড়ে গেছে। এমনি তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে মেয়েটি মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও দরকার।

তিনি আরও বলেন, মেয়েটির যে ক্ষত হয়েছে তার দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা দরকার। তার শরীরে রক্ত কম আছে। মেয়েটি সর্বনিম্ন সাত থেকে আটটি অস্ত্রোপচার লাগবে। তিন থেকে চারমাস হাসপাতালে থাকতে হবে।

জানা গেছে, পৈশাচিক নির্যাতন চালানো গৃহকর্ত্রীর নাম দিনাত জাহান আদর। এরই মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে রোববার (২০ অক্টোবর) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দিনাত জাহান আদরের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে ভাটারা থানা পুলিশ। পরে আদালত তার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ভুক্তভোগী কিশোরীর মা বলেন, ‘কিশোরীর বাবা বেকার। মেয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে সংসার চালান। কিশোরীর পাঁচ বোন এক ভাই। অভাবের কারণে গত পাঁচ বছর আগে এক মহিলার মাধ্যমে ওই বাসায় দশ হাজার টাকায় কাজে দেই মেয়েকে। এরপর আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। শুধু মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাইতো। আর পাঁচ হাজার নাকি কল্পনার ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে মেয়ের এই অবস্থা দেখতে পাই। প্রথমে আমার মেয়েকে দেখে চিনতে পারি নাই। অনেক পরে চিনতে পারছি। এইভাবে একটা মেয়েরে মারতে পারলো। যে মারছে সে তো মানুষ না, জানোয়ার। আমি এর বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’

এদিন দুপুরে কল্পনাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলে আসেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অনেক পরিবার দারিদ্র্যতার জন্য অন্যের বাসায় কাজ করে। তাই বলে নির্মমতার শিকার হবে এটাতো মেনে নেয়া যায় না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই মেয়েটিকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মেরে তার চারটি দাঁত ফেলে দেয়া হয়েছে। তার শরীরে সব ধরনের আঘাত রয়েছে। একটা সুস্থ মানুষ এ ধরনের নির্যাতন করতে পারে না। আমাদের দেশে পাঁচ লাখের মতো মেয়ে শিশু শ্রমিক আছে। যারা বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিবারের তারা আছে। এই মেয়েটা পাঁচ বছর ধরে একটা পরিবারে কাজ করে। সাড়ে চার বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কেউ জানেও না। এরকম আরও কত হচ্ছে কা কেউ জানি না।

তিনি আরও বলেন, এই যে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন দিনের পর দিন এই দেশে হচ্ছে, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, এটা বন্ধ করা উচিৎ। আমরা বারবার বলে আসছি যে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন করা প্রয়োজন। আমরা সর্বশেষ আইনের একটা খসড়া প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে সাবমিট করেছি। আমরা বারবার বলছি দ্রুত প্রস্তুত করে আইনটি পাশ করা দরকার। কারণ পুর্ণাঙ্গ আইনে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়টিকে দেখা হয় না। যে ঘটনা সমসাময়িক ভাবে ঘটছে, তা কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। যারা এরকম নিষ্ঠুর আচরণের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো রকমের নমনীয়তার অবকাশ নাই।

ড. কামাল উদ্দিন বলেন, এই মেয়েটিকে বসুন্ধরার যে বাসায় নির্যাতন করা হয়েছে, দিনাত জাহান সে একাই বাসায় থাকতো। তবে তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেই কাজে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তার বাবা মা রেহাই পাওয়ার কথা নয়। দিনাত জাহান এডাল্ট তবুও তার বাবা মা এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধেও যাতে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়, এমন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা।

উল্লেখ্য, শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাতে বসুন্ধরার আই ব্লকের তিন নম্বর রোডের ৪৬৬ নম্বর বাসা থেকে ওই কিশোরীকে (১৩) উদ্ধার করে ভাটার থানা পুলিশ। পরে রাত সোয়া ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল বার্ন প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়।

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে ওই গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার সারা শরীরে পোড়া ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। গতরাতেই গৃহকর্মীর মা বাদী হয়ে নারী শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। মামলায় গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান আদরকে (২১) গ্রেপ্তার করা হয়।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ