Thursday, November 7, 2024

ইসরাইল ও ইরান বন্ধু থেকে ঘোর শত্রু হলো যেভাবে

আরও পড়ুন

লেবাননের শিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান সম্প্রতি ইসরাইলকে লক্ষ্য করে দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইহুদি রাষ্ট্রটির ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পাল্টা এ ক্ষেপণাস্ত্র চালায়। তেল আবিবের মাটিতে তেহরানের নজিরবিহীন এ হামলাকে কেন্দ্র করে পুরো মধ্যপ্রাচ্য এখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।

গত মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেয়ার হুঙ্কার দেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

ইসরাইল ও ইরান ছিল একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র

ইসরাইল ও ইরান বর্তমানে একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক অবস্থানে থাকলেও দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক কিন্তু এখনকার মতো তিক্ত ছিল না। বরং বলা যেতে পারে, তাদের মধ্যে মধুর সম্পর্কই বিদ্যমান ছিল। এমনকি নিজেদের অভিন্ন শত্রু ইরাকের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কও বিদ্যমান ছিল।

মূলত ইরানের ইসলামি বিপ্লব পূর্বের রাজতান্ত্রিক শাসক রেজা শাহ পাহলভির শাসনামলেই এই সম্পর্ক জোরদার হলেও এমনকি ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ৮০-এর দশকে তৎকালীন বিপ্লবী সরকারের আমলেও দুই দেশের মধ্যে গোপনে সামরিক সম্পর্ক বজায় ছিল। গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের দখলদারি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে এই বিষয়টি অসম্ভব হিসেবে মনে হলেও বিগত শতাব্দীর ৮০-এর দশকে তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা হলে বিষয়টি মোটেও আশ্চর্যজনক মনে হবে না।

কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সে প্রাচীনকাল থেকেই ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই নীতি ব্যাপকভাবে চর্চা হয়ে আসছে। এই নীতির অংশ হিসেবেই ৮০-এর দশকে উভয়ের সাধারণ শত্রু ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে শায়েস্তা করতে একাট্টা হয়েছিল ইসরাইল ও খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইরানের বিপ্লবী সরকার। প্রকাশ্যে না হলেও অত্যন্ত গোপনে তাদের মধ্যে অব্যাহত ছিল সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা।

ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র ইরান

ইরান ও ইসরাইলের এই সহযোগিতার সূত্রপাত শুরু হয় ইহুদিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। ইরানের সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই ১৯৫০ সালেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেন ইরানের তৎকালীন রাজতান্ত্রিক শাসক রেজা শাহ পাহলভি। তুরস্কের পর ইরানই ছিল ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দ্বিতীয় মুসলিম জনগণ অধ্যুষিত রাষ্ট্র।

এর পর থেকে ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহলভির আমলে দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। বিশেষ করে ষাটের দশকে যখন সোভিয়েত পন্থি বাথ পার্টি ইরানের প্রতিবেশী ইরাকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তখন ইরান ও ইসরাইল উভয় দেশেরই অভিন্ন শত্রু হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে বাথ পার্টি নিয়ন্ত্রিত ইরাক। উভয় পক্ষই নিজেদের আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে ইরাককে।

ইরাককে ঠেকাতে একাট্টা হয় ইসরাইল ও ইরান

মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের আধিপত্য ঠেকাতে অত্যন্ত গোপনে একাট্টা হতে থাকে তেলআবিব ও তেহরান। যার নেতৃত্ব দেয় দুই দেশের দুই কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা ইসরাইলের মোসাদ ও রেজা শাহ পাহলভির গোয়েন্দা বাহিনী সাভাক। ইরাককে কাবু করতে ষাটের দশকে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একযোগে কাজ শুরু করে এই দুই গোয়েন্দা সংস্থা।

এক পর্যায়ে এ দুপক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয় তৎকালীন সময়ে ঘোর পশ্চিমাপন্থি হিসেবে পরিচিত তুরস্কও। বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে ইরাকের তৎকালীন রাজা দ্বিতীয় ফয়সালকে উৎখাত করে যখন আরব জাতীয়তাবাদী সামরিক কর্মকর্তা আব্দুল করিম কাসিম দেশটির ক্ষমতা দখল করেন তার পর থেকেই সোভিয়েত ঘেঁষা ইরাকের জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে একাট্টা হয় এই তিন দেশ। এর অংশ হিসেবে ১৯৫৮ সাল থেকেই তুরস্ক, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কর্মকাণ্ড শুরু হয়, যা অব্যাহত থাকে শাহের শাসনামলজুড়ে।

ষাটের দশকে ইরানের সঙ্গে ইসরাইয়েলের এ সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইসরাইলের প্রভাবকে কাজে লাগাতে তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ওঠেপড়ে লাগেন ইরানের রেজা শাহ পাহলভি। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ব্যাপারে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তা সামাল দেন তিনি। শুধু তাই নয়, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন তিনি।

ইরানের বিপ্লবী সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখে ইসরাইল

যদিও ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সম্পূর্ণ বদলে যায় ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশেষ করে যখন ইরানের শাসন ক্ষমতায় আসে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বাধীন ঘোর পশ্চিমা বিরোধী কট্টরপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী। তবে অবাক ব্যাপার হলো এই সময়েও ইসরাইলের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বিশেষ করে সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখে তৎকালীন তেহরানের বিপ্লবী সরকার। আর প্রধান কারণ ছিল উভয় পক্ষের ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত ইরাকের শাসক হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের উত্থান।

এতদিন পর্দার আড়াল থেকে ইরাকের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এলেও ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন সাদ্দাম হোসেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন তিনি, যার জেরে শুরু হয় প্রায় দশকব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধ। মূলত এ যুদ্ধ শুরুর পরই নিজ নিজ প্রয়োজনে কাছাকাছি আসে ইসরাইল ও খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামি বিপ্লবী সরকার। কারণ উভয় পক্ষেরই অভিন্ন শত্রু ছিলেন সাদ্দাম হোসেন।

পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার বাসনা থাকায় উচ্চাভিলাষী সাদ্দাম হোসেনকে নিজেদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে হুমকি মনে করতো ইসরাইল। পক্ষান্তরে সাদ্দাম হোসেনের আরব জাতীয়তাবাদী নীতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ইরানের জন্য। এ অবস্থায় সামরিক ভাবে শক্তিশালী ইরাককে প্রতিহত করতে ইরানকে শরণাপন্ন হতে হয় ইসরাইলের। এর অংশ হিসেবে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ইরানের খোমেনি নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে ‘সবুজ সংকেত’ দেন। এটা ছিল সাদ্দামের নেতৃত্বে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ইরাককে ঠেকানোর জন্য ইসরাইলের হিসাবি সিদ্ধান্ত।

এক্ষেত্রে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষোধাজ্ঞাও উপেক্ষা করে ইহুদি রাষ্ট্রটি। ইসরাইলের এই সহযোগিতার বিপরীতে প্রতিদান হিসেবে জাতিগতভাবে ইরানি ইহুদিদের নিরাপদে দেশত্যাগ করে ইসরাইলে যাওয়ার সুযোগ দেন খোমেনি।

ইরানকে এফ-৪ জঙ্গিবিমানের চাকা সরবরাহ করে মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর এক অদ্ভূত পরিস্থিতিতে পড়ে ইসরাইল। ইরানের তৎকালীন সরকার পশ্চিমা বিরোধী হলেও তারা সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামায় তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরাইল। কারণ ইরানের ইসলামি সরকারের বদলে উচ্চাভিলাষী সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী ইরাককে নিয়েই সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত ছিল ইসরাইল।

অন্যদিকে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ও পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুদ্ধের প্রথম দিকে ব্যাপক বেগ পেতে হয় সদ্য ইরানের ক্ষমতায় আসীন বিপ্লবী সরকারকে। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের বিমানবাহিনীর বহরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এফ-৪ জঙ্গিবিমানের স্পেয়ার পার্টসের সংকট সামাল দিতে ইসরাইলের দ্বারস্থ হয় খোমেনির সরকার।

১৯৮১ সালে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর পর একই বছরের অক্টোবর মাসে ইসরাইল গোপনে ইরানকে এফ-৪ জঙ্গিবিমানের ২৫০টি চাকা সরবরাহ করে। রেজা শাহ পাহলভির আমলে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা এ এফ-৪ জঙ্গি বিমানই ছিল ইরানের বিমানবাহিনীর মূল শক্তি। ইসলামি, বিপ্লবের পর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এই জঙ্গিবিমানের স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহের উপায় বন্ধ হয়ে যায় ইরানের জন্য। এ পরিস্থিতিতে সাদ্দামকে সামলাতে ইরানের সাহায্যে এগিয়ে আসে ইসরাইল।

নিউইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদন অনুযায়ী, এফ-৪ জঙ্গি বিমানের টায়ারগুলো উৎপাদন করা হয় ইসরাইলেই। পরবর্তীতে তা গোপনে পাঠানো হয় ফ্রান্সে। সেখান থেকে বিশেষ বিমানে করে টায়ারগুলো পাঠানো হয় ইরানে।

যদিও পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসনের চাপে ইরানকে আরও সামরিক সহযোগিতা দেয়া থেকে সরে আসে ইসরাইল। তবে এটা গোপন ছিল না যে সাদ্দাম হোসেন যেন ইরানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারে, তা ছিল ইসরাইলেরও অভিলাষ।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ