রয়্যাল এনফিল্ড (Royal Enfield) শুধু একটি মোটরসাইকেল নয়, এটি ঐতিহ্য। ১০০ বছরেরও পুরোনো এই কোম্পানির দীর্ঘ ইতিহাস, ক্লাসিক ডিজাইন এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা একে একটি আইকনিক ব্র্যান্ড করে তুলেছে। মার্সিডিজ, বিএমডব্লিও’র মতো এই ব্র্যান্ডটিও তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে দেখা হয়।
ইংল্যান্ডে সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য যাত্রা শুরু করা এই বাইকটি আজ বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন টু-হুইলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত। ১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে এই ব্র্যান্ড। ধীরে ধীরে রয়্যাল এনফিল্ড ভারতীয় মোটরসাইক্লিংয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। যদিও ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তবুও ভারতে এর জনপ্রিয়তা কমেনি।
বর্তমানে ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আইশার মোটরসের অধীনে পরিচালিত রয়্যাল এনফিল্ডের ১২টি মডেল ৫০টিরও বেশি দেশে বিক্রি হচ্ছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির বিক্রি রেকর্ড ৯ লাখ ইউনিট ছাড়িয়েছে। ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা এবং নেপালে রয়্যাল এনফিল্ডের সংযোজন কারখানা স্থাপিত হয়েছে।
দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারেও রয়্যাল এনফিল্ড-এর আগমন ঘটে। আগমনটা আবার হয়েছে বেশ রাজসিক, একেবারে ৩৫০ সিসির মোটরসাইকেল নিয়ে। বাংলাদেশের ইফাদ গ্রুপ ভারতের রয়্যাল এনফিল্ডের সাথে যৌথ উদ্যোগে দেশে এই মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ইফাদ মটরস লিমিটেড একটি আধুনিক উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে স্থানীয়ভাবে বিশ্বমানের মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে এনফিল্ডের আগমন দেশের মোটরসাইকেল উৎসাহীদের জন্য একটি বিশাল বড় খবর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি বিপণিবিতান কেন্দ্রগুলোয় মোটরবাইক প্রেমীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি তারই প্রমাণ দেয়।
রয়্যাল এনফিল্ড চালকদের একটি বড় কমিউনিটি রয়েছে। বাংলাদেশেও এই কমিউনিটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। একসঙ্গে রাইড করা, মিটিং করা এবং এই মোটরসাইকেল সম্পর্কিত বিভিন্ন আয়োজন করা হয়।
বলে রাখা ভালো, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে ১৬৫ সিসির উপরে মোটরসাইকেল বাজারজাত করার অনুমতি ছিল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দেশে ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেয়।
রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইন অনন্য এবং আকর্ষণীয়। রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইন কখনোই পুরোনো হয় না। ক্লাসিক লুক, ক্রোম ফিনিশিং এবং বিস্তারিত নকশা একে অন্য মোটরসাইকেল থেকে আলাদা করে।
আশা করা যায়, রয়্যাল এনফিল্ড-এর পাশাপাশি অন্যান্য ব্র্যান্ডও তাদের উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সিসির মোটরসাইকেল খুব দ্রুতই বাজারে নামাবে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে বাংলাদেশ ট্রেড ও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ এবং ইফাদ গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলোর দীর্ঘদিনের চেষ্টা রয়েছে।
রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইন অনন্য এবং আকর্ষণীয়। রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইন কখনোই পুরোনো হয় না। ক্লাসিক লুক, ক্রোম ফিনিশিং এবং বিস্তারিত নকশা একে অন্য মোটরসাইকেল থেকে আলাদা করে। ইঞ্জিনিয়ারিং পয়েন্ট থেকে বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে বেশি সিসির মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক ভালো।
মজবুত ফ্রেমের সাথে ট্রান্সমিশন সিস্টেমও খুব কেয়ারফুলি ডিজাইন করা হয় বিধায় এটি দীর্ঘ যাত্রায় বেশ আরামদায়ক রাইডিং অভিজ্ঞতা প্রদান করে। যেকোনো ইঞ্জিনের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য সাধারণত ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভাষায় ‘ব্রেক হর্সপাওয়ার’ (সংক্ষেপে বিএইচপি) টার্মটি ব্যবহার করা হয়।
যে চারটি মডেল (হান্টার, ক্লাসিক, বুলেট ও মিটিয়র) দিয়ে রয়্যাল এনফিল্ড বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে সেগুলোর মধ্যে ডিজাইন, পারফরম্যান্স এবং ফিচারগুলোয় কিছু ভিন্নতা থাকলেও বিএইচপি সবগুলোরই প্রায় ২০-এর কাছাকাছি, যেটি সাধারণ বাইকের তুলনায় বেশ বেশি।
তবে উচ্চ বিএইচপি-সম্পন্ন ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্রেক করার সময় এটিকে নিরাপদে থামিয়ে আনা। এদিকটি মাথায় রেখে এনফিল্ডের ইঞ্জিনগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেম (এবিএস)। এবিএস সিস্টেম ব্রেক করার সময় চাকাগুলো লক (স্কিডিং) করা থেকে বাধা দেয়, ফলে জরুরি অবস্থায় (যেমন বিপজ্জনক পিচ্ছিল রাস্তায়) ড্রাইভারকে বাইকের উপর আরও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
শক্তিশালী ইঞ্জিনের সাথে নিরাপদ ব্রেকিং সিস্টেম থাকায় অফ-রোড এডভেঞ্চারপ্রেমী বাইকার যারা দুর্গম জায়গায় ট্যুরে যান, তাদের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে এটি।
উচ্চমানের উপকরণ এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু বেশি হওয়ায় রয়্যাল এনফিল্ডের দাম অন্যান্য মোটরসাইকেলের তুলনায় কিছুটা বেশি। এনফিল্ডের বাইকগুলোর দাম হাঁকা হয়েছে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার মধ্যে। মার্কেটে থাকা অন্যান্য মোটরবাইকগুলো তুলনামূলক কম দামেই পাওয়া যায়।
এছাড়া ইঞ্জিনের পাওয়ার বেশি হলেও, ইঞ্জিনের সিসি (আয়তন) যেহেতু বেশি, সেহেতু এটার মাইলেজ (প্রতি লিটারে কত মাইল বা কিলোমিটার চলে) তুলনামূলকভাবে কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। জনাকীর্ণ ঢাকা শহরের যানজটে এনফিল্ডের মাইলেজ আরও কমে যেতে পারে, সুতরাং যারা নিত্যদিনের যাতায়াতে বাইক ব্যবহার করে থাকেন, তাদের এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।
দেশের জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে বর্তমান বাজারে বহুল জনপ্রিয় জাপানি ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা, ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, টিভিএস ও হিরো এবং দেশীয় ব্র্যান্ড রানার-এর মতো মোটরবাইকেগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এনফিল্ডের প্রাইস এবং মাইলেজ দুটো বিষয়েই কাজ করতে হবে। রয়্যাল এনফিল্ডের সার্ভিস সেন্টারের সংখ্যা এখনো অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় কম। তবে কোম্পানিটি সার্ভিস নেটওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে।
দেশে মোটরসাইকেলের বাজার এখন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, আমদানি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলের প্রায় ৯৯ শতাংশই হয় দেশে তৈরি নয়তো সংযোজন। করোনা মহামারি পরবর্তীতে দেশে মোটরসাইকেলের বাজারে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল সেটা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠা গেছে।
মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্পের উন্নয়নে নীতিমালার পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা এ খাতকে আরও গতিশীল করেছে। সম্প্রতি ডলার সংকটের কারণে এলসি সংক্রান্ত জটিলতায় বাইকের যন্ত্রাংশ নির্মাণ সাময়িক বাধাগ্রস্ত হলেও আশা করা যায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে মোটরসাইকেলের বাজার বহুগুণ বেড়ে যাবে।
দেশের জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে বর্তমান বাজারে বহুল জনপ্রিয় জাপানি ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা, ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, টিভিএস ও হিরো এবং দেশীয় ব্র্যান্ড রানার-এর মতো মোটরবাইকেগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এনফিল্ডের প্রাইস এবং মাইলেজ দুটো বিষয়েই কাজ করতে হবে।
এরই মধ্যে রয়্যাল এনফিল্ডের মতো অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলোর উচ্চ সিসির বাইকগুলো বাজারে চলে এলে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে মোটরসাইকেলের প্রতি আগ্রহ অনেকটাই বেড়ে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, সড়কে অননুমোদিত যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, চালকদের অভিজ্ঞতার অভাব, সড়কের খারাপ অবস্থার পাশাপাশি বেপরোয়া বাইকারদের অসদাচরণের জন্যে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাও বেড়েছে।
রয়্যাল এনফিল্ডের মতো হাই পারফরম্যান্স বাইকগুলোর উপযোগিতা পুরোপুরি পেতে হলে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। চালক, সরকার এবং সমাজের সবস্তরের মানুষকে মিলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। না হয় গ্রাহকের প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মধ্যে রয়ে যাবে বিস্তর ফারাক, যা একান্তই কাম্য নয়।