সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এখন পর্যন্ত ১৪ জন নারীকে বিয়ে করেছেন নাটোরের গুরুদাসপুরের প্রতারক আবু সাঈদ (৩০)। কখনও সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কখনও পুলিশ, আবার কখনও বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কমার্শিয়াল পাইলট পরিচয়ে বিয়ে করেছেন তিনি।
বিয়ের পর স্ত্রীর স্বজনদের সরকারি প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এমন পাঁচ স্ত্রীর ঘরে রয়েছে পাঁচটি সন্তান।
আবু সাঈদ উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের তালবারিয়া গ্রামের মো. সোহেল রানার ছেলে। দীর্ঘদিন লাপাত্তা প্রতারক সাঈদের নামে রয়েছে থানায় একাধিক মামলা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকলেও সাঈদকে উচ্চশিক্ষিত করতে পারেননি তারা। গ্রামের মোড়ে বাবার স্টুডিও দোকানে বসতেন তিনি। সেখানেই শেখেন ফটোশপের কাজ। এরপর নিজের রূপ পরিবর্তন করে ফেসবুকে ছাড়তেন ছবি। এভাবেই বিভিন্ন নারীর সঙ্গে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক।অতঃপর বিয়ে করে সেই নারীদের সঙ্গে কিছুদিন পার করার পর কৌশলে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা।
সাঈদ ২০১০ সালে জামালপুরের মাউশি এলাকায় প্রথম বিয়ে করেন। ২০১২ সালে রাজশাহী শহরে ও পাবনার চাটমোহরে দ্বিতীয় ও তৃতীয়, ২০১৩ সালে ঢাকাতে চতুর্থ, ২০২২ সালে টাঙ্গাইল ও নাটোরের লালপুরে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম, ২০২৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অষ্টম ও নবম, ২০২৪ সালে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, বরিশাল ও সবশেষ ১৪তম বিয়ে করেন ঠাকুরগাঁও।
পঞ্চম স্ত্রী খাদিজা আক্তার সাবিনা জানান, প্রায় আড়াই বছর আগে টিকটকে পরিচয় হয় আবু সাঈদের সঙ্গে। পরিচয় দিয়েছিলো বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কমার্শিয়াল পাইলট। বেশ কিছুদিন কথা বলতে বলতে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। নিজের পরিচয় দিতেন বাবা-মা হারা এতিমখানায় বড় হয়েছেন তিনি। সব মেনে নিয়ে টাঙ্গাইল সদরের বিউটি পার্লার মালিক ও একজন এনিজও পরিচালনা সেই নারীর সঙ্গে ১৫ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় তার।
তিনি বলেন, বিয়ের কিছুর দিন পার হলে তার প্রতি আমার বিশ্বাস তৈরি হয়। আমাদের ঘরে জন্ম নেয় একটি সন্তান। আমার দুই বোন ও এক ভাতিজির জন্য চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাঈদ ৩০ লাখ টাকা নেয়। কয়েকদিন পর আমার কাছ থেকেও দশ লাখ টাকা নেয়। এভাবে মোট ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয় সে। মোবাইল ফোনও বন্ধ করে রাখে। দীর্ঘদিন লাপাত্তা থাকার পর সাঈদের খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সাঈদ একজন প্রতারক। এর আগেও বিয়ে করেছেন একাধিক নারীকে। সব স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি প্রায় সবার সঙ্গেই প্রতারণা করেছেন তিনি। আরও চার স্ত্রীর ঘরে চার সন্তান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিয়ের পর সাঈদ আমার বাড়িতেই থাকতো। তবে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মেয়ে তার নম্বরে কল দিতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো অফিসের সহকর্মীরা। একপর্যায়ে সাঈদের আসল ঠিকানা এবং তার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারি। তবে সাঈদ বুঝতে পেরেছিলো আমি সব জেনে গেছি। চাকরির জন্য যে নিয়োগ পত্র দিয়েছিলো সেগুলোও ভুয়া। একারণে আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সাঈদ। নিরুপায় হয়ে টাঙ্গাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে সাঈদের নামে মামলা দায়ের করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাঈদের চতুর্থ স্ত্রী জানান, তিনি কক্সবাজারের একটি উন্নতমানের হোটেলে চাকরি করেন। টিকটকে তিন বছর আগে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। এনএসআই কর্মকর্তা হিসাবে তখন পরিচয় দিয়েছিলো। এভাবেই কিছুদিন কথা বলতে বলতে প্রেম হয় তারপর বিয়ে। বিয়ের পর তার চাকরি করে জমানো প্রায় ১০ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাহানা করে নিয়ে নেয়। টাকা নেওয়ার কয়েকদিন পরেই মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে পালিয়ে যায়। আজ পর্যন্তও তার সন্ধান পাননি তিনি।
কথা হয় সাঈদের আরও পাঁচজন স্ত্রীর সঙ্গে। তারাও জানান, যেসব নারী প্রতিষ্ঠিত ও অর্থ সম্পদ আছে সেই সব নারীদের টার্গেট করে সাঈদ টিকটক ও ফেসবুকে সম্পর্ক গড়ে তুলতো। সম্পর্কের পর বিয়ে করে। বিয়ের পর অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার পর তার সন্ধান আর পাওয়া যায়না।
সাঈদের প্রতিবেশী মাসুদ রানা জানান, সাঈদ ফটোশপের কাজে ভাল অভিজ্ঞ ছিলো। নিজের ছবি এডিট করে সরকারি কর্মকর্তা, পাইলট, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ডিবিসহ বিভিন্ন রুপ ধারণ করতে পারতো। সেই ছবি গুলোই ফেসবুক-টিকটকে পোস্ট করতো বিভিন্ন আকর্ষনীয় শিরোনামে। সহজেই সুন্দরী মেয়েরা ফাঁদে পরতো সাঈদের।
সাঈদের বাবা সোহেল রানা জানান, আমার দুই সন্তান। বড় ছেলে সাঈদের জন্য কোথাও মুখ দেখাতে পারিনা। লজ্জা হয়, মাঝে মাঝে মরে যেতেও মন চায়। শুধু স্ত্রী ও ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে আর পারিনা। কোনমতে স্থানীয় বাজারে একটি স্টুডিওর দোকান পরিচালনা করে সংসার পরিচালনা করি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েরা তার সন্ধানে আসে এবং ছেলের বউ হিসাবে পরিচয় দেয়। কিন্তু সাঈদের সঙ্গে গত চার বছরে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। আমাদের খোঁজ খবরও রাখেনা। পাশ্ববর্তী গ্রামে সাঈদকে বিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ঘরে একটা সন্তান রয়েছে। সেটিই ছিলো প্রথম স্ত্রী। ওই মেয়েটা দীর্ঘদিন সাঈদের অপেক্ষায় থেকে এখন বাবার বাড়িতে চলে গেছে। এখন আমি মনে করি আমার একটি সন্তান। সাঈদ নামের কোন ছেলে আমার ছিলোনা।
এ বিষয়ে গুরুদাসপুর থানার ওসি মো. উজ্জল হোসেন জানান, সাঈদের নামে পূর্বে চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। তবে ১৪ নারীকে বিয়ে করেছে ও অর্থ আত্মসাত করেছে এমন কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত থানায় কেউ দেয়নি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।