Thursday, November 7, 2024

‘হাসিনাই পারে নাই আর এখন তো গোয়েন্দাগুলো দুর্বল হয়ে আছে’

আরও পড়ুন

বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ নিয়ে ভয়াবহ এক কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়েছে। এর সঙ্গে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এবং বিতর্কিত দুজন যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও আলী আযম সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য ফুটে উঠেছে। সেই সিনিয়র সচিবের সঙ্গে এক যুগ্ম সচিবের হোয়াটসঅ্যাপে সংবেদনশীল কথোপকথনে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে উঠে এসেছে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের তথ্যও। যে কথোপকথনের কিছু স্ক্রিনশট রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলেও ঘুরপাক খাচ্ছে, যা নিয়ে তোলপাড় চলছে খোদ প্রশাসনের ভেতরেও। এ কথোপকথনের অতি সংবেদনশীল কিছু অংশের স্ক্রিনশট কালবেলার হাতে এসেছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের দায়িত্ব নেওয়া নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে বিপাকে ফেলতে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ডিসি ‘নিয়োগকাণ্ড’ ঘটানো হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকে বিষয়টিকে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।

এ ব্যাপারে জানতে ফোন করা হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস করা হলে জবাবে তিনি লেখেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না’। অন্যদিকে যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি এক যুগ্ম সচিবের কক্ষ থেকে ৩ কোটি টাকার একটি চেক এবং ডিসি নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু চিরকুট উদ্ধার সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। সাড়া জাগানো সেই প্রতিবেদন নিয়ে তোলপাড় তৈরি হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ঘটনা তদন্তে এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে যে কর্মকর্তার দিকে সন্দেহের আঙুল উঠেছিল, সেই যুগ্ম সচিবকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এর আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কালবেলার ওই প্রতিবেদনকে ‘গুজব’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে দাবি করেছিলেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট থেকেই তাদের (মোখলেস-জিয়া) মধ্যে কথোপকথনের কিছু তথ্য হস্তগত করে সরকারের বিভিন্ন মহল। আলাপচারিতায় সিনিয়র সচিব যুগ্ম সচিব জিয়াকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা না বলে সরাসরি কথা বলতে বলেন। কারণ এখন তিনি সংবেদনশীল চেয়ারে আছেন এবং তাকে গোয়েন্দারা নজরে রাখছে বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু সরকার পতনের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগের মতো ‘সক্রিয় নয়’ দাবি করে ড. জিয়া সিনিয়র সচিবকে আশ্বস্ত করেন। এরই মধ্যে তারা হোয়াটসঅ্যাপ কলেও কথা বলেন। আলাপচারিতার একটি খুদেবার্তায় (মেসেজ) ডিসি নিয়োগ নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে এবং এখন কেউ কিছু করতে পারবে না বলে সচিবকে আশ্বাস দেন জিয়া। একটি মেসেজে সচিব নিজেকে ‘নির্লোভ’ দাবি করে মাত্র ৫ কোটির একটি আবদার করেন। জিয়া তাকে সুখবর দিয়ে বলেন ১০ কোটি রাখার কথা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে সচিব তাকে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার যেটা ভালো মনে হয়।’ তবে টাকা-পয়সার প্রতি নিজের তেমন লোভ নেই বলেও জিয়াকে জানান সচিব।

আলাপে সচিব গোয়েন্দা সংস্থাকে ‘গিরগিটি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন জিয়াকে। এ বিষয়ে জিয়া ওই সিনিয়র সচিবকে অভয় দিয়ে কোনো টেনশন না নিতে আশ্বস্ত করেন। আলাপে সচিব অর্ধেক ডলারে আর বাকিটা তার লোকের কাছে নগদে (ক্যাশ) দেওয়ার জন্যও বলেন।

তারা আলাপকালে ডিসির জন্য নামগুলো গোপনে টাইপ করে নিয়ে আসতে বলেন জিয়াকে। তবে ডিসি নিয়োগ নিয়ে ‘বিদ্রোহ’ এড়াতে চারজনের নাম নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন সচিব। পরে প্রজ্ঞাপনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর ডিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নিযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ওপর দায় চাপানো; জনপ্রশাসনের এপিডির অতিরিক্ত সচিবকে বাইরে রাখা এবং এসএসবির বিশেষ সদস্য আকমল হোসেন আজাদের বিষয়টির প্রসঙ্গও উঠে আসে। এ ছাড়া ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন কবে হবে, সেটিও উঠে আসে এবং তাদের কথোপকথন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওই দিনেই ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হয়।

বৈষম্যের শিকার হওয়া কর্মকর্তাদের দাবি, দুই যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও আলী আযমের নীল নকশাতেই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের টাকার বিনিময়ে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ, হট্টগোলের ঘটনায় যুগ্ম সচিব আলী আযমকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সিলেটে বদলি করা হয়। অন্যদিকে, হট্টগোলের ঘটনায় সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড এসএসবির বিশেষ সদস্য ও স্বাস্থ্য সচিব আকমল হোসেন আজাদকে প্রধান করে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশে হট্টগোলে জড়িত থাকার অভিযোগে মন্ত্রণালয় ১৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য জানান জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব, যা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় গত মঙ্গলবার রাতে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। রাজধানীর বিয়ামে হওয়া ওই সভা থেকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য সরকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আরেক যুগ্ম সচিবের কথোপকথনের তথ্য ফাঁস হলো।

খুদেবার্তায় ভয়ানক তথ্য: হোয়াটসঅ্যাপের খুদেবার্তার আলাপচারিতা থেকে দেখা যায়, মোখলেস উর রহমানের যোগদানের পরই তাকে অভিনন্দন জানান ড. জিয়া। ওইদিন রাত ৯টা ৩ মিনিটে সচিবকে ড. জিয়া লিখেছেন, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার, অভিনন্দন স্যার।’ ৯টা ১৭ মিনিটে সচিব জবাব দেন ‘ধন্যবাদ জিয়া। কাল একবার এসো দেখা কইরো। সামনাসামনি কথা বলব।’ জিয়া লেখেন, ‘জি স্যার।’ সচিব আবার লেখেন ‘কাল একবার ওইখানে আইসো।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘অবশ্যই স্যার।’ রাত ৯টা ২৮ মিনিটে জিয়া বলেন, ‘স্যার সবাই প্রশংসা করছে।’ ৯টা ৪২ মিনিটে সচিবের জবাব, ‘কী বলে?’ জিয়ার জবাব, ‘স্যার সবাই বলে মোখলেস যোগ্য লোক, মোখলেস Harvard থেকে পড়ে আসছে।’ এরপর ৯টা ৪৪ মিনিটে জিয়া হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও সিনিয়র সচিব রিসিভ করেননি। পরে ৯টা ৫৬ মিনিটে সচিব কল ব্যাক করে জিয়ার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলেন। এ সময় কী কথা হয়েছে, তা জানা যায়নি। এরপর ৩০ আগস্ট শুক্রবার রাত ৮টা ১০ মিনিটে সচিব জিয়াকে লেখেন, ‘যা করবা খুব সাবধানে করবা, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া অন্য নম্বরে টেক্সট দিবা না।’ ৮টা ১৬ মিনিটে জিয়ার প্রতিউত্তর, ‘ঠিক আছে স্যার, আমি গুছাই আসছি। এখন কেউ কিছু করতে পারবে না।’ ৮টা ২১ মিনিটে সচিব বলেন, ‘আসলে আমার তেমন দরকার নাই 5c হলেই হবে।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার আপনার জন্য 10c রাখব।’ এবার সচিব বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার যেটা ভালো মনে হয়। টাকা-পয়সার প্রতি তেমন লোভ নাই আমার। গিরগিটিগুলোর প্রতি খেয়াল রাইখো।’ জিয়া বলেন, ‘স্যার আমি সতর্ক আছি, আপনি টেনশন নিয়েন না।’ রাত ৮টা ৩২ মিনিটে সচিব আবার লেখেন, ‘ডলারে দিও অর্ধেক 5c; বাকিটা ক্যাশ দিও আমার লোকের কাছে।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার আপনি যেভাবে বলবেন।’ সচিব বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে তো প্রবলেম নাই।’ জিয়ার জবাব, ‘না স্যার। হাসিনাই পারে নাই আর এখন তো গোয়েন্দাগুলো দুর্বল হয়ে আছে।’ এরপর সচিব ৮টা ৩৯ মিনিটে জিয়াকে কল করেন এবং এ সময় তাদের মধ্যে তিন মিনিট কথা হয়। ৯টা ১৮ মিনিটে জিয়া সচিবকে বলেন, ‘স্যার একটা পক্ষ ৫০/৫২টা চায়। ওদের এটা দিতে হবে। নইলে ঝামেলা হবে।’ এরপর ৯টা ২০ মিনিটে সচিব জিয়াকে কল করে ৫০ সেকেন্ড কথা বলেন। ৯টা ২৬ মিনিটে জিয়া এবার লেখেন, ‘ওরা ২০০ দিবে।’ ‘ওরা জানতে চাইছে এটা কোথায় নিবেন? সিঙ্গাপুরে নাকি থাইল্যান্ডে নিবেন?’ mode of payment কি হবে?’ সচিব লেখেন, ‘তুমি আর আযম ঠিক করে নাও।’ এরপর ৯টা ৪১ মিনিটে জিয়া সচিবকে কল দিলেও কথা হয়নি। পরে ১০টা ২২ মিনিট ও ১০টা ২৭ মিনিটে সচিব জিয়াকে দুইবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি। এরপর ১০টা ৩১ মিনিটে জিয়া এবার লেখেন, ‘স্যার আমি গ্যারান্টি।’ সচিবের জবাব, ‘পারলে ফাইভ সি (পাঁচ কোটি) আগে দিও।’ জিয়া বলেন, ‘ঠিক আছে স্যার।’ এবার সচিব বলেন, ‘গোপনে টাইপ করায় নিয়ে আইসো, আমি পাস করাই দিব, ওদের মধ্য থেকে তিন-চারজনকে রাইখো।’ জিয়া বলেন, ‘জি স্যার, …কে রাখছি।’ সচিব আবার বলেন, ‘খুব ভোরে গোপনে আইসো।’ জিয়ার জবাব, ‘ঠিক আছে স্যার।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৩ আগস্ট ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা ড. জিয়াউদ্দিনকে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসনে ন্যস্ত করে সরকার। ওইদিনই তিনি যোগদান করেন। এরপর ১৮ আগস্ট আরেক দফা পদোন্নতি দিয়ে তাকে যুগ্ম সচিব করা হলে ওইদিনই তিনি যোগদান করেন। আর সিনিয়র সচিবের সঙ্গে তার আলাপচারিতার তথ্য তার পরের। অন্যদিকে অবসর থেকে ফিরে ২৮ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মোখলেস উর রহমান। ওইদিনই তিনি যোগদান করেন।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ