Friday, November 8, 2024

ঢাকার দুই মেয়র ও কাউন্সিলররা লাপাত্তা

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় সাড়ে ১৫ বছর অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পরই এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গে দলটি সমর্থিত ঢাকার দুই করপোরেশনের সিটি মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা লাপাত্তা। তারা কোথায় আছেন জানেন না করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া দীর্ঘদিন করপোরেশনে দুর্নীতিগ্রস্ত ও আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তারাও কোনো ছুটি ছাড়াই নগর ভবনে আসছেন না। নগর পিতাদের অনুপস্থিতিতে এই মুহূর্তে করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যারা অফিসে আসছেন তারা কোনোরকম রুটিন কার্যক্রম শুরু করেছেন।

বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি, টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়েছে। জবাবে ইটপাটকেল ও সড়কে অগ্নিসংযোগে ভঙ্গুর দশা হয়েছে সড়ক, ফুটপাত, সড়ক বিভাজক ও সড়কবাতিগুলোর। এখনো নগরীর যত্রতত্র পড়ে রয়েছে আবর্জনার স্তূপ, ইটপাটকেল ও গৃহস্থালি বর্জ্য। শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে অনেক এলাকায় পরিষ্কার করলেও বেশিরভাগ এলাকার ফুটপাত, সড়ক বিভাজক, সড়কবাতি এখনো অকেজো। আঞ্চলিক ও কাউন্সিলরদের অনেক অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। সন্ধ্যার পর নগরীর অধিকাংশ সড়কে অন্ধকার নেমে আসে। এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে নগরজুড়ে। গত দুদিনে রাত হলেই নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তার জন্য নগরবাসী নিজেরাই টিম করে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন।

এদিকে এখন ডেঙ্গু মৌসুম চলছে। বিদ্যমান অবস্থায় মশক নিধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্বসহ ১৭ ধরনের সনদ ইস্যু চলছে না। কাউন্সিলর ও আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও অফিস করছেন না। তারা সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হামলার আতঙ্কে রয়েছেন। আর কাউন্সিলররা এলাকাবাসীর দ্বারা অপহৃত হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায় নগর সেবা কার্যক্রম কার্যত বন্ধই বলা চলে। দক্ষিণ সিটির এক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বর্জ্য অপসারণ, মশক নিধন, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ কিছু কাজ কাউন্সিলররা তত্ত্বাবধান করতেন। কিন্তু তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে এসব কাজ হচ্ছে না। ডেইলি বেসিস কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। কোনো কোনো সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলররাও নেই। করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এর উপ-কর কর্মকর্তা তাসিম হাসান বাঁধন বলেন, সরকার পতনের আগে থেকেই করপোরেশনে কর্মকর্তারা আসছেন না। গতকাল বৃহস্পতিবারও এই অঞ্চল অফিসে অধিকাংশ কর্মকর্তায় আসেননি।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সকালে গুলিস্তান নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংক্ষুব্ধ, বঞ্চিত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার কর্মচারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতারা নগর ভবনে টহল দিচ্ছেন। মেয়র সেল, বিভাগীয় প্রধানদের দপ্তরে তারা ঘোরাঘুরি করছেন। দীর্ঘদিন যারা নগর ভবন পরিচালনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তারা গত দুদিন অফিস খোলা থাকলেও অফিসে আসেননি।

এদিকে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি করে পদোন্নতি পেয়ে সিটির কর্মকর্তাদের নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহাল করছেন—এই অভিযোগ তুলে প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের কক্ষের দরজায় লাথি মেরে গালাগাল করেন কর্মচারীরা।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলমান রাখতে মেয়রের অনুপস্থিতিতে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সব কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি সভা ডাকেন। কিন্তু এই সভায় ৭৫ জন কাউন্সিলরের মধ্যে প্যানেল মেয়রসহ ৬৫ জন অনুপস্থিত ছিলেন। পরে সিইও বিএনপিপন্থি ১০ কাউন্সিলরদের নিয়ে দ্রুত নগরীর বর্জ্য অপসারণ, মশক কার্যক্রম এবং সড়কবাতি মেরামতের বিষয় নিয়ে বৈঠক করেন।

বৈঠকে উপস্থিত ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মীর হোসেন মীরু বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চলমান পরিস্থিতি উত্তরণে সব কাউন্সিলরদের ডেকেছেন। কিন্তু সেখানে প্যানেল মেয়র কেউ উপস্থিত ছিলেন না। আমরা বিএনপির আটজন সাধারণ আসনের কাউন্সিলর আর সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম ও সামসুন্নাহার ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।

করপোরেশনের এই পরিষদের মেয়াদ আরও সাত-আট মাস আছে। মেয়র আর বাকি কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতে করপোরেশন কীভাবে চলবে এই প্রশ্নে মীরু বলেন, সিটি করপোরেশন নিয়মের মধ্যে চলে। মেয়র আর প্যানেল মেয়ররা যদি অনুপস্থিত থাকেন তবে যারা উপস্থিত আছেন তাদের নিয়ে আবার প্যানেল মেয়র গঠন হবে। নতুন সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে সবকিছু জানা যাবে।

ডিএসসিসির এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কালবেলাকে জানান, সিটি করপোরেশনের সেবা কাজের পাশাপাশি উন্নয়ন কাজও বন্ধ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় অনেক প্রকৌশলীর সঙ্গে ঠিকাদাররাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। করপোরেশনের যে কোনো কাজ মেয়র আর তার কাছের প্রকৌশলীদের পছন্দের ঠিকাদাররা পেত। এখন সব উন্নয়ন কাজের সাইটে কে বা কারা তালা মেরে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি তাতে সহজে এসব সাইটে কাজ শুরু করা কঠিন হবে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী মো. মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আবর্জনা পরিষ্কারের রুটিন কাজ শুরু হয়েছে। অন্যান্য কাজও শুরু হবে। মেয়র কোথায় আছেন জানি না। তিনি কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। কার নির্দেশনায় কাজ চলবে, তা এখনো জানি না। দেখা যাক নতুন সরকার কি সিদ্ধান্ত দেয়। এখনো যেহেতু করপোরেশন পরিষদের মেয়াদ আছে। নীতিমালা ও নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

গতকাল দুপুরের পরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) গুলশান নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, যথানিয়মে অফিস চলছে। শীর্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস শুরু করেছেন। তবে উপস্থিতি অনেক কম। দীর্ঘদিন যারা নগর ভবন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং নানাভাবে বিতর্কিত তারা অফিসে আসছেন না। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারেন—এমন আতঙ্কে রয়েছেন তারা।

গতকাল বিকেলে সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শোডাউন করেছেন। এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলনে মিরপুর, উত্তরা আর মোহাম্মদপুরে কাউন্সিলরদের লোকজন ছাড়াও কয়েকজন সরাসরি হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন।

ডিএনসিসি সূত্র জানায়, উত্তর সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত চার কাউন্সিলর প্রকাশ্যে আছেন। তাদের একজন ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী আকবর কালবেলাকে বলেন, এখনো অচলাবস্থা চলছে। করপোরেশন থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ