ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তকও; শেখ হাসিনার বাণী বাদ দিয়ে আর গণ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি যোগ করে বই ছাপানোর প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছে।
চলমান শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের পাশাপাশি সব স্তরের পাঠ্যবই পরিমার্জনে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার অংশ হিসেবে এমন যোগ-বিয়োগ হচ্ছে।
এর অংশ হিসেবে প্রায় পাঠ্যবইয়ের পেছনের মলাটে আর থাকছে না ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী। সেখানে যুক্ত হচ্ছে জুলাই-আগস্ট গণ আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি।
পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ছাপার দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
বর্তমান পাঠ্যবইতে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বেশি প্রাধান্য পেলেও নতুন বইতে যুক্ত হবে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের মত অন্যদের অবদানও।
একই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট গণ আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধদের ‘বীরত্বগাথা’ বছরের পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।
অপরদিকে আগের বছরগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের নিয়মিত কিছু লেখকের লেখাও বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার খবর এসেছে। বিশেষ করে যারা আগের সরকারের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ ছিলেন।
এছাড়া বইগুলোতে যেন কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে আঘাত করার মত কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত না হয় সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এনসিটিবি।
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট জনরোষ থেকে বাঁচতে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে যান। এর তিন দিন পর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদ্ষ্টো হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ‘আলোচিত-সমালোচিত’ নতুন শিক্ষাক্রম থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৈরি করা শিক্ষাক্রম ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’।
“আমরা আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাব। কিন্তু এমনভাবে যাব যেন কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় কোনো অস্বস্তি না হয়। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কীভাবে আমরা আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাব সেটা পর্যালোচনা হচ্ছে।”
এরপরই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আবার নতুন করে ভাবনা ও সংশয় তৈরি হয়েছে নতুন কী পরিবর্তন আর পরিমার্জন আসতে যাচ্ছে তা নিয়ে।
গত এক যুগ ধরে শিক্ষা ব্যবস্থা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকাতয় সবশেষ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে ‘শিক্ষাক্রম-২০২২’ প্রস্তুত করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
সেই আলোকে ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানও করা হয়। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিও যুক্ত হয় সেই শিক্ষাক্রমে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, মাধ্যমিকের আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেওয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
চাপ কমাতে বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের আগে শিক্ষাবর্ষজুড়ে চালু হয় শিখনকালীন মূল্যায়ন। বেশ কিছু বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হয় শতভাগ।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা আবার আমূল পাল্টে ফেলার কথা বলা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, মাধ্যমিকে ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ; যেখানে মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে সেই এক যুগ আগের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ এর মত।
এরপর শিক্ষাবর্ষের নবম মাসে এসে গত ১ সেপ্টেম্বর ওই কারিকুলাম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর আগামী বছরের পাঠ্যপুস্তক কেমন হবে সে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
এমন পরিস্থিতিতে এক যুগ আগে ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম অনুসারে সংশোধিত ও পরিমার্জিত বই নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার কার্যক্রম চলছে তুলে ধরে তিনি বলেন, যার যতটুকু অবদান তাই অন্তর্ভুক্ত হবে নতুন পাঠ্যবইতে।
কী কী পরিবর্তন আসছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বর্তমান বইতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছিল। এর সঙ্গে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের অবদানও অন্তর্ভুক্ত হবে।
“জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার একাধিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেগুলোও সেভাবে পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত হবে।”
এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশ একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা বইয়ে ছিল দীর্ঘদিন ধরে, সেটি এবার সরিয়ে ফেলা হবে বলে এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার প্রধান সম্পাদক ফাতিহুল কাদির ফাতিহুল কাদির।
বর্তমান পাঠ্যবইয়ের পেছনের মলাটে শেখ হাসিনার নানা বাণী স্থান পেয়েছে। যেগুলোতে তাকে “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা নামের বইয়ের পেছনের মলাটে লেখা আছে, “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান এবং নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের পেছনে লেখা আছে, “সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যোগ্যতা অর্জন করো – মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”।
আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ের পেছনের মলাট থেকে শেখ হাসিনার এমন বাণী বাদ পড়ছে জানিয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, “ওগুলো অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এর পরিবর্তে কিছু বইয়ের পেছনের মলাটে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
“আর জুলাই বিপ্লবের শহীদ আবু সাঈদ-মীর মুগ্ধদের বীরত্বগাথা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদিও এখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হলে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে কার কার বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে।”
চলতি বছরের শুরুতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফার গল্প’ নামের একটি গল্প নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল।
তবে নতুন বছরের পাঠ্যবইতে কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত করার মত কোনো বিষয় স্থান পাবে না জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, “এ বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।”
তবে হাতে সময় কম থাকায় এবারের পাঠ্যপুস্তকে খুব বেশি পরিবর্তনের সুযোগ না থাকার কথা বলেছিলেন এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা শাখার প্রধান সম্পাদক ফাতিহুল কাদির।
কিছু দিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নির্দেশে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লেখক-সম্পাদকদের একটি প্যানেল তৈরি করা হয়। ওই প্যানেল বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ করছে।
“বইগুলো একেবারে আমূল পরিবর্তন করার সময় আমাদের হাতে নাই। তাহলে আবার জানুয়ারির ১ তারিখে বই দেওয়া যাবে না।”
কী কী পরিবর্তন আসছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাঠ্যবইয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য, ইতিহাসের বিকৃতি, অতিমাত্রায় ব্যক্তি তোষণ, বিষয়বস্তুতে অসত্য বিষয়, কাউকে কাউকে সরিয়ে ফেলার ব্যাপার আছে; সেগুলো বাতিল করা হবে। তবে কাউকে একেবারে বাদ দেওয়া বা অস্বীকারও করা হবে না।”
তিনি বলেন, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য তৈরি করা পাঠ্যবইয়ের ওপরই পরিবর্তন আর পরিমার্জন করছেন তারা।
“এর বাইরে আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ সময় খুবই কম।“