কারো পুড়েছে বাড়ি, কারো ভেঙেছে ফ্রিজসহ আসবাবপত্র। এভাবে ৫০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে ভষ্মীভূত করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই ৩ বেলা খাওয়া হয়নি গত শনিবার থেকে। নিজের বাড়ি হারিয়ে থাকছেন অন্যের বাড়িতে। সাংবাদিক এসেছে শুনে কাঁদতে কাঁদতে পোড়া বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করছেন।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার খাশিয়াল বাজারে কিছু ভাঙচুরের ছবি পাওয়া গেলো। বাজারের পাশেই জাফর বিশ্বাসের বাড়ির কয়েকটি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আগুনে গাছের পাতা পর্যন্ত পুড়ে যাবার চিহ্ন পাওয়া গেলো। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেলো বই-খাতাসহ সবকিছু পুড়ে ভষ্মীভূত হয়েছে। একটু পরেই জাফর মোল্যার দুই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। ছোট মেয়ে সুমাইয়া গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আনার্সের ছাত্রী। অভিযোগের সুরে বললো, পুলিশের সামনেই আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিলো, আমার সমস্ত বই খাতাসহ সনদ পুড়ে ছাঁই হয়ে গেলো। আমাদের বাড়িতে কোন পুরুষ মানুষ নাই আমরা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
জাফর মোল্যা ছাড়াও আগুনে পুড়েছে চঞ্চল শেখ, আইয়ুব মোল্যা, শওকত শেখ, মুকুল শেখ, আতাউর শেখ, আশরাফ শেখসহ অন্তত ৫০টি বাড়ি। এসব বাড়ির পুরুষেরা ঘর ছেড়ে পালিয়ে আছেন। নিজের একমাত্র বসত ঘরটি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে প্রতিপক্ষ। ঘরের টিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে কোথাও কোন ভালো চিহ্ন নেই। ঘর হারিয়ে উত্তর পাড়ার আমেনা বেগম গর্জে উঠলেন। বললেন, আমি আমার ছোট বাচ্চা নিয়ে কোন রকমে ঘর থেকে বের হইছি। আমার কোন থাকার জায়গা নাই, আল্লাহ আমার ঘর যারা পুড়াইছে তাদের ও যেন সবকিছু পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।
এলাকায় অধিকাংশ মানুষই বিএনপি সমর্থক। জেলা বিএনপি সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িও একই এলাকায় জানা গেছে, খাশিয়াল গ্রামে ওহাব শেখ ও জাফর মোল্যা এই দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের কোন্দল বিরাজমান। চলতি ঘটনার শুরু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নড়াইলে আসে ওসিকুল নামের একজন জামাতকর্মী। এই মিছিলে আসাকে কেন্দ্র করে বাকবিতন্ডায় গত ৯ আগস্ট তাকে মারধর করে জাফর মোল্যা গ্রুপের লোকজন। এর জের ধরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ওহাব শেখের লোকজন জাফর মোল্যাকে কুপিয়ে জখম করে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে জাফর মোল্যার লোকেরা। ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাফর মোল্যার লোকজন জগন্নাথ খাসিয়াল বাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র মিলন শেখকে কুপিয়ে হাত ও পায়ের আঙ্গুল কেটে ফেলে।
এরপর শুক্রবার রাতেই দুইপক্ষ ঘোষণা দিয়ে শনিবার হামলায় লিপ্ত হতে চাইলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তা থেমে যায়, শনিবা র(২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানে দেশীয় অস্ত্র একটি রাইফেলসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। সেনাবাহিনী এলাকা থেকে চলে যাবার পরপরই সকাল ১১ টা থেকে ওহাব শেখের লোকেরা জাফর মোল্যা গ্রুপের লোকদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা খাশিয়াল উত্তর পাড়ার বিভিন্ন বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ভাঙচুর চলে রাত অবধি। এলাকার লোকেরা ভয়ে এ
ঘটনায় কোন মামলা করেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাত্রদল নেতা মিলন শেখের পরিবারে চলছে হতাশা। বৃদ্ধবাবা আবু হানিফ শেখ ছেলের পঙ্গুত্বের জন্য কাঁদছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মিলনের হাত ও পায়ের সবগুলো আঙ্গুলই কেটে ফেলেছে প্রতিপক্ষের লোকেরা। বর্তমানে সে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মিলনের মেজভাই চুন্নু শেখ জানান, ঢাকায় আন্দোলন করেছে আমার ভাই, সে কোন গ্রাম্য কোন্দলে জড়িত নয়। আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই প্রায় বিদেশ থাকি। তাকে যেভাবে মারলো আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। পরবর্তী বাড়িঘর ভাঙচুর আগুনে আপনারা জড়িত কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা আমাদের ভাইকে চিকিৎসা দিতেই ব্যস্ত রয়েছি, তবে শুনেছি মিলনের করুন অবস্থা দেখে ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে।
এ ব্যাপারে নড়াগাতি থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পুলিশের সামনে ঘটেছে এটা ঠিক নয়, সেনাবাহিনী চলে যাবার পরে আগুন আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। তারা কোন অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।