Thursday, November 7, 2024

২০ টাকার সবজি হাতবদল হয়ে ভোক্তার ঘরে পৌঁছায় ১২০ টাকায়!

আরও পড়ুন

এ যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের দেশ! মহাসড়কে নেই চাঁদাবাজি কিংবা পুলিশি উৎপাত। তারপরও কৃষকের ২০-২৫ টাকার ফসল ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে দাম ওঠে যায় একশ টাকার ওপরে। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা যেমন থাকেন লোকসানে, তেমনি সবজি কিনতে হিমশিম খান ক্রেতারা। কীভাবে হয় হাতবদল, আর কীভাবে বাড়ে সবজির দাম, তা দেখতে কৃষকের ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত যায় সময় সংবাদ।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া। নিভৃত এ পল্লির কৃষক আবুল হোসেন। চলতি মৌসুমে লাউ ফলিয়েছেন তিনি। মাথার ঘাম পায়ে মাড়িয়ে দীর্ঘ পরিচর্যা শেষে তার ক্ষেতে দেখা দেয় সাফল্যের ঝিলিক! তারপরও লোকসানে কেন পড়তে হয় তাকে?

ক্ষেত থেকে কত দরে বিক্রি হচ্ছে এ ফসল — জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম কমবেশি যাই হোক, বিক্রি করতেই হয়। তবে ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি পাওয়া যায় না।

সাটুরিয়ার কৃষক আবুল হোসেন, যিনি লাউ চাষ করে গ্রামের বাজারে ব্যাপারীদের কাছে ২০ টাকায় বিক্রি করলেও ভোক্তার কাছে সেই লাউ বিক্রি হয় ১২০ টাকায়। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া

একই এলাকার আরেক কৃষক আবেদ আলী; চাষ করেছেন বেগুন, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়শ, পটোলসহ কয়েক প্রকারের সবজি। কিন্তু প্রতিবছরের মতো এবারও তার মুখে নেই স্বস্তির হাসি।

তিনি বলেন, ‘বাজারে নিয়ে গেলে কমবেশি যাই হোক দিয়া আইতে হয় আমাগো। ব্যাপারীরা যা দাম দেয়, তাই দিয়া বেচতে হয়।’

আবুল হোসেন ও আবেদ আলীর মত অনেক কৃষককে স্থানীয় বাজারে দারস্থ হতে হয় পাইকারদের কাছে। এখানে প্রথম দফা দাম বাড়ে সবজির। ক্ষেতে যে লাউ ২০ থেকে ২৫ টাকা ছিলো; দুই কিলোমিটার পথ যেতে না যেতেই দাম হয়ে যায় দ্বিগুণ। লাউয়ের মতো অন্যসব সবজিরও একই দশা।

কৃষক পর্যায়ে বরবটির দাম কেজিতে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, ব্যাপারীর কাছে দাম বেড়ে হয়ে যায় ৬০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে বেগুনের দাম কেজিতে ৩০ টাকা, ব্যাপারীর কাছে দাম বেড়ে হয়ে যায় ৪৫ টাকা। পটোলের কৃষক পর্যায়ে দাম ২৮ থেকে ৩০ টাকা, আর ব্যাপারীর কাছে ৪২ টাকা। করলার কৃষক পর্যায়ে দাম ৩৫ টাকা, ব্যাপারীর কাছে ৫০ টাকা। পেঁপের কৃষক পর্যায়ে দাম ১৪ থেকে ১৭ টাকা, আর ব্যাপারীর কাছে দাম বেড়ে হয়ে যায় ২০ থেকে ২৫ টাকা। চিচিঙ্গার কৃষক পর্যায়ে দাম ৩২ থেকে ৩৫ টাকা, আর ব্যাপারীর কাছে ৪০ থেকে ৪৩ টাকা। ঢ্যাঁড়শের কৃষক পর্যায়ে দাম ৪৫ টাকা, আর ব্যাপারীর কাছে হয়ে যাচ্ছে ৬০ টাকা।

এসব সবজি স্থানীয় বাজারে কৃষকদের কাছ থেকে কিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খুচরা বিক্রির জন্য নিয়ে যান ব্যাপারীরা। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে হাত বদল হয় কয়েক ধাপে। কৃষক থেকে যায় ব্যাপারীর কাছে, সেখান থেকে আড়ত, তারপর পাইকার এবং সবশেষে খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে যায় ভোক্তার হাতে। এর প্রতিটি ধাপেই বাড়তে থাকে দাম।

স্থানীয় কয়েকটি বাজার থেকে সবজিগুলো সংগ্রহের পর সেগুলো মালবাহী ট্রাকে তোলা হয়। তারপা নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজারে। এসব ট্রাকের সঙ্গে ঢাকার কারওয়ান বাজারের পথে যায় সময় সংবাদও।

বাড়তি মূল্যের কারণ হিসেবে এতোদিন বলা হতো মহাসড়কের চাঁদাবাজি। সে চাঁদাবাজির দশা জানতে পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে পুরো পথ করা হয় অনুসরণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোথাও নেই চাঁদাবাজির আলামত। ট্রাকচালকরাও জানালেন, এখন পথে দিতে হয় না কোন চাঁদা — সেটা দেশের যে প্রান্তেই হোক।

মধ্যরাতে কারওয়ান বাজরে এসে পৌঁছায় সবজির ট্রাক। ততক্ষণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রামের পাইকারদের মাধ্যমে আসা ট্রাকে ভরে গেছে কারওয়ান বাজার।

অনুসন্ধান বলছে, এখানেও তিন ধাপে হাত বদল হয় শাক-সবজির। প্রথমে ব্যাপারীদের কাছ থেকে দরদাম করে কিনে নেন আড়তদাররা, তারপর নেন পাইকাররা। প্রতিটি ধাপেই চলে মূল্য বৃদ্ধির মহোৎসব। কৃষকের ২০ টাকার লাউ ততক্ষণে পেরেয়ি গেছে সেঞ্চুরি।

এখানেই শেষ নয়। কারওয়ান বাজারের মতো বড় বাজারগুলো থেকে সবজি যায় পাড়া-মহল্লার বাজার ও ভ্যানগাড়িতে। সেখানেও আরেক দফা দাম বেড়ে কৃষকের সেই ২০ টাকার লাউ ভোক্তার কাছে বিক্রি হয় ১২০ টাকায়।

কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে ৫-৬ ধাপের হাত বদল আর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এসব সবজির দাম বাড়ে কয়েকগুণ। এতে হাতবদলের কারিগরদের ভাগ্য বদলালেও লোকসানের ভার বইতে হয় সাধারণ কৃষকের। একই সঙ্গে অসাধু সিন্ডিকেটের জন্য বাড়তি এ মাশুল দিচ্ছেন ক্রেতারা।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ