দীর্ঘদিন ধরে দেশে চলছে ডলার সংকট। নানা উদ্যোগ নিয়েও এ সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। রেমিট্যান্স-রপ্তানিসহ বৈদেশিক আয়ের চেয়ে আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধে বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ সংকট থেকে উত্তরণে নানা উপায়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। এরপরও ১২০ টাকার নিচে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অতিরিক্ত ডলার হুন্ডির মাধ্যমে আবারও বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যতটা সম্ভব ডলার সঙ্গে নিয়ে বর্ডার পার হয়ে অন্য দেশে চলে গেছেন, অনেকে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। আবার যারা পালিয়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন, তারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে ডলার নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে প্রতি মাসে আমদানির জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রপ্তানি আয় তিন বিলিয়ন ডলার। বাকি দুই বিলিয়ন ডলারের চাহিদা পূরণ করছে রেমিট্যান্স। কোনো কোনো মাসে আড়াই বিলিয়ন ডলারও আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডলারের দাম কেন ১২০ টাকার নিচে নামছে না?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকে বর্তমানে এলসির চাহিদা কম, কমেছে বিদেশে ভ্রমণ, চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও কমেছে। আবার আগামী জানুয়ারি মাসের আগে পড়ালেখা কেন্দ্রিক বিদেশে ডলার পেমেন্টের চাপও তৈরি হবে না। এ অবস্থায় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে ডলার দেশে আসছে তা আবার হুন্ডি হয়ে বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশের সম্পদ রক্ষা করতে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান, আমলে নেওয়া অভিযোগ এবং কমিশনের গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের অর্ধশত মন্ত্রী-এমপি বিপুল অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা, এর বেশির ভাগই বিদেশে পাচার করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যানুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে অন্তত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টাকা পাচারের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা। আবার রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা এত দিন সম্ভব হয়নি। এর সঙ্গে দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তবে পাচারের টাকা ফেরানোর এখনই উপযুক্ত সময়।’
এদিকে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ৭২টি সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদের বেশির ভাগ তিনি গড়েছেন হুন্ডি পাচারের মাধ্যমে। বিষয়টি তদন্তের জন্য ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) কাছে চিঠি লিখেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি আফসানা বেগম।
পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস আসন থেকে নির্বাচিত আফসানা বেগম জানান, শুধু যুক্তরাজ্য নয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিভিন্ন দেশে যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়ও অনেক সম্পদ রয়েছে।
সম্প্রতি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ভারতের কলকাতার একটি পার্কে দেখা গেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ বলছে, তিনি হয়তো অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেছেন। তিনিও হুন্ডি পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৬ আগস্ট ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর ঝালকাঠির বাসভবন থেকে ডলার, ইউরোসহ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, বিদেশে পালানোর জন্য তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাই টাকা ও ডলার নিয়ে বাসায় জড়ো করেছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ঝালকাঠি শহরের রোনালসে রোডে আমির হোসেন আমুর বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা লাগেজ ভর্তি এই টাকা দেখতে পান। পরে বিষয়টি সেনাবাহিনী ও পুলিশকে জানালে তারা এসে লাগেজ ভর্তি টাকা উদ্ধার করেন।
২৪ আগস্ট ভারত সীমান্ত থেকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি সীমান্তে প্রতারিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। দালালরা মারধর করে তার কাছে থাকা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে বলেও জানান। তখনো তার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ পাসপোর্ট, ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও কিছু টাকা। সূত্র বলছে, এই বয়সে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার ব্যাগ বহন করা সম্ভব নয়। এসব টাকা ছিল ডলার ফরম্যাটে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে যুক্ত বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এস এম জামান বলেন, ‘বর্তমানে খোলাবাজারে ডলারের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় বর্তমানে লেনদেনও স্বাভাবিক। তবে আগের চেয়ে খোলাবাজারে ডলার এনডোর্সমেন্ট কিছুটা কমেছে। কারণ বর্তমানে বিদেশে ভ্রমণ ও বিদেশে চিকিত্সা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে। আশা করছি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির আরেকটু উন্নতি হলে খোলাবাজারে ডলার লেনদেন পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। আর যারা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানান, বর্তমানে ডলারের বাজার স্থিতিশীল। কারণ ডলারের চাহিদা কমে গেছে। কয়েক মাস আগেও ব্যবসায়ীরা ডলারের জন্য হাহাকার করতেন। কিন্তু বর্তমানে তাঁরাই আর এলসি করতে চাচ্ছেন না। এতে কমার্শিয়াল হুন্ডি কমে এসেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের মতো বড় আকারের হুন্ডি পাচার বন্ধ হলেও দেশ থেকে খুচরা হুন্ডি পাচার এখনো বন্ধ হয়নি। ফলে অতিরিক্ত ডলার বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
তথ্য মতে, ব্যাংকিং চ্যানেলে বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২১ টাকা পাচ্ছেন প্রবাসীরা। আর খোলাবাজারে এই রেট সর্বোচ্চ ১২২ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর উদ্যোগে বর্তমানে হুন্ডিতে সুবিধা করতে পারছে না হুন্ডিচক্র। অফিশিয়াল রেট ও হুন্ডির রেট কাছাকাছি চলে আসায় প্রবাসীরা বর্তমানে ব্যাংক চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এ অবস্থায় হুন্ডির কারবার বন্ধ করা গেলে বর্তমানে বছরে আসা ২৫ বিলিয়ন ডলার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০ বিলিয়ন করা সম্ভব।
বিগত সরকারের আমলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছিল প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিদেশ থেকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি কারবারিদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে ১০টি প্রতিবন্ধকতার কথাও বলা হয়েছিল।
হুন্ডির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডি বন্ধ হলে রেমিট্যান্স অনেক বাড়বে। তবে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিংসহ যেসব মাধ্যমে মুদ্রাপাচার হয়, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এর সুবিধাভোগী কারা এবং কাদের সহায়তায় এটি হয়, তা খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। তাই দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রবাস আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে যারা বিদেশে আছেন, তাঁদের বৈধ পথে নিয়ে আসতে হবে। রেমিট্যান্স পাঠাতে যেসব ভোগান্তি আছে তারও সমাধান করতে হবে।’