পদের দিক থেকে তিনি ছোট কর্মকর্তা। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ছাড়িয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ের অনেক বড় কর্মকর্তাকে। দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও প্রতারণার মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিলেন আদালত। তবে মামলা বহাল থাকলেও এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি ওই কর্মকর্তার। ফেরত দেননি আত্মসাৎ করা টাকাও। উল্টো আতঙ্কে আছেন তার অপকর্মের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কারণ শাস্তির পরিবর্তে ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে ভালো গুরুত্বপূর্ণ পদায়নের পাশাপাশি বাগিয়ে নিয়েছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব। আলোচিত এই ব্যক্তি হলেন বস্ত্র অধিদপ্তরের ইন্সট্রাক্টর মো. ছামিদুল হক।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ছামিদুল হক বস্ত্র অধিদপ্তরের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জের টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী ওই পদটি দশম গ্রেডের। ২০১৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের সুপারিনটেনডেন্ট স্বাভাবিক অবসরে গেলে ওই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব নেন জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর ছামিদুল হক। যদিও নিয়ম অনুযায়ী দশম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা ষষ্ঠ গ্রেডের ওই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তবে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, বস্ত্র অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছামিদুলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, টাইম স্কেল মঞ্জুর করার আশ্বাস দিয়ে ছামিদুলের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে প্রায় তিনশ কর্মচারীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
জানা গেছে, সানারপাড়ে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জের টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে একজন উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক থাকলেও ছামিদুল হক একই পদে নোয়াখালী থেকে নিজের হাসান ইমাম নামে আরেকজনকে নিয়ে আসেন। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিনটি খাতে প্রায় ৩ কোটি টাকার অনিয়মের ঘটনা ঘটে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় এই অনিয়ম ধরা পড়ে। পরে নারায়ণগঞ্জের জেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দিয়ে অডিট আপত্তি
নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত সেই নির্দেশনা মানা হয়নি।
শুধু সরকারি অর্থ আত্মসাৎই নয়, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের ছয় শিক্ষক-কর্মচারীর সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের (প্রভিডেন্ড ফান্ড) প্রায় ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগপত্রে বলা হয়, জিপিএফ হিসাবের স্থিতি দেখতে অনলাইন থেকে জিপিএফ হিসাব স্লিপ বের করে দেখা যায়, অগ্রিম ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। অথচ তারা ঋণের টাকার জন্য কোনো আবেদনই করেননি। পরে জেলা অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের প্রধান ছামিদুল হকের স্বাক্ষরিত জিপিএফ মঞ্জুরি আদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক হাসান ইমাম হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর মো. মাসুমের কাছ থেকে চেক উত্তোলন করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ওই কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না।
জানা যায়, জিপিএফ ফান্ডের টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত পত্র দিতে হয়। এ ছাড়া স্বাক্ষর মিলিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু টাকা উত্তোলনকারী টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক হাসান ইমাম প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মচারী নন। তাকে ছামিদুল হক নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রতিষ্ঠানে রেখেছিলেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে সোহেল রানা নামে একজন ছামিদুল হকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। তবে ছামিদুল নিজেকে নির্দোষ দাবি করায় আদালত ভুয়া কিংবা জাল কাগজপত্রে তার স্বাক্ষর যাচাই-বাছাই করার জন্য ঢাকায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপারের (ফরেনসিক) কাছে পাঠান। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই কাগজপত্রের স্বাক্ষরগুলো ছামিদুল হকের। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এসব অনিয়ম জানার পরও বস্ত্র অধিদপ্তর এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে পিরোজপুরে প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বসহ বদলি করে। তবে বদলির সেই আদেশও তিনি দীর্ঘদিন আমলে নেননি। সর্বশেষ স্ট্যান্ড রিলিজ করার পর যোগ দেন পিরোজপুরে।
শুধু এসব অপকর্মই নয়, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তার সময়ে সানারপাড়ের ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে মাত্র দেড়শতে নেমে আসে। বর্তমানে সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা সাড়ে তিনশ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ছামিদুলের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বস্ত্র অধিদপ্তরের একজন পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় ছামিদুল নানা অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে বস্ত্র অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও ভয়ে কেউ উচ্চবাচ্চ করেন না।
জানা যায়, এত অপকর্মের পরও ছামিদুলের বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ফের পুরস্কৃত করার আয়োজন চলছে। বস্ত্র অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে তাকে সানারপাড়ের ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে বদলির প্রস্তাব করা হয়। সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অতিরিক্ত দায়িত্বও। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
সার্বিক বিষয়ে ছামিদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এত অনিয়ম করে কি বাংলাদেশে বাঁচা যায়! এত অনিয়মের পর ডিপার্টমেন্ট কি আমাকে আস্ত রাখত। আমাকে তো এতদিনে তুলাধুনা করে ফেলার কথা। আপনারা আরও যাচাই-বাছাই করে দেখুন, সবই আসলে ষড়যন্ত্র।’
বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নুরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘ছামিদুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগের তদন্ত চলছে। তাকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। আগের কর্মস্থলে ফিরিয়ে এনে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
এত অভিযোগ থাকার পরও তাকে কেন আগের কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সুপারিনটেনডেন্ট সংকট রয়েছে। তাই চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়।’
যোগাযোগ করা হলে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ ওই কর্মকর্তাকে না চেনায় তার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।