‘খেয়ে না খেয়ে আমি এই মামলার পেছনে ঘুরছি, কিন্তু হাকিম কি রায় ঘোষণা করলো। আমার রাতে দিনে ঘুম নাই। আল্লাহ আমাকে দুনিয়াতে কেন রাখল। আজ আমার স্বামী থাকলে ছেলেও থাকতো। স্বামী-সন্তান হারাইলাম, বিচারও পাইলাম না। বেঁচে থেকে আমার লাভ নাই।’
আফসোস করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ১১ বছর আগে গরুর বাছুর ধান খাওয়াকে কেন্দ্র করে নিহত নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কৃষক মো. ইউছুফের (৫০) স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৪৫)।
২০১৩ সালের ১৮ জুন সুবর্ণচর উপজেলার চর জব্বর ইউনিয়নের জাহাজ মারা গ্রামে প্রতিবেশীদের হাতে নিহত হন মো. মোস্তফার ছেলে মো. ইউছুফ। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ১৯ জুন চরজব্বর থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত ৭ জুলাই দুপুরে দীর্ঘ ১১ বছর পর ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার ৯ আসামিকে খালাস দিয়ে ৫ ও ৬ নম্বর আসামি মৃত আবুল কালামের ছেলে আবদুস সাত্তার (৪৩) ও স্বপনকে (৩৩) ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন নোয়াখালী বিশেষ জজ আদালতের বিচারক এএনএম মোর্শেদ খান।
ন্যায়বিচার পাননি দাবি করে ইউছুফের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে বিচারক তাদের খালাস দিয়েছেন। আমার একমাত্র ছেলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এসে চিন্তায় স্ট্রোক করে মারা গেছে। আসামিরা আমার স্বামীকে হত্যা করেও আজ দিব্যি বাহিরে আর আমি বিছানায় পড়ে আছি। বিচারক আমাদের কাগজপত্র ঠিকমতো দেখেননি। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। দুনিয়াতে আমার থাকা আর না থাকা এক। আমার কোনো মূল্য নাই। কী বিচার পাইলাম আমি?
নিহতের দ্বিতীয় মেয়ে তাসলিমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চারটা বোন বাবা বলে ডাকতে পারি না। আমাদের একমাত্র ভাইটাও সাক্ষ্য দিয়ে মারা গেছে। ১১ বছর ধরে আমরা রায়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু কী রায় দিল আমরা ভাবতেই পারি না। ১১ বছর বাবাকে ছাড়া আমরা কত কষ্টে দিনাতিপাত করেছি। আল্লাহ তা দেখেছেন। আমরা আসামিদের ফাঁসি চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রার্থনা আসামিরা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৮ জুন বিকেলে নিহত ইউছুফের ভাই আবদুর রহিমের গরু আসামি মো. জাহেরের ধান খায়। তাই জাহের গরুটি বাড়ির গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখেন। খবর পেয়ে আবদুর রহিমের ছোট ছেলে মামুন গরু আনতে গেলে জাহের চড়-থাপ্পড় দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। মামুন কাঁদতে কাঁদতে তার বাবা আবদুর রহিমকে জানালে সে জাহেরের বাড়িতে যায়। আবদুর রহিম তার ছেলেকে মারধরের কারণ জিজ্ঞেস করলে জাহের মারধর করতে আসে। আবদুর রহিম দৌড়ে পালাতে যান। জাহের আবদুর রহিমকে দৌড়ে ধরে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। চিৎকার শুনে আবদুর রহিমের ভাই ইউছুফ ও বেলাল এগিয়ে আসলে জাহেরের ভাই আবদুস সাত্তার ইউছুফের নাক ফাঁটিয়ে দেন। পরে তাকে স্থানীয় চেউয়াখালী বাজারে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাজার থেকে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ি ফিরলে আগে থেকে ওৎ পেতে আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীর ইউছুফকে মাথায় আঘাত করেন, আবদুল মান্নান বাম চোখে ঘুষি দেন, আবুল কাশেম রড দিয়ে ইউছুফকে মারাত্মক জখম করেন, আবদুস সাত্তার ও অন্যান্যরা লাকড়ি দিয়ে আঘাত করেন। এতে ইউছুফের চিৎকারে মানুষজন আসলে আসামিরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা ইউছুফকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেলা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠাতে বললে হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ইউছুফ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের ভাই আবদুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসামিরা আমার ভাইকে কিরিচ দিয়ে লাকড়ি দিয়ে মাথা, বুকে-পিঠে আঘাত করছে। আমাকে ও আমার ছোট ভাই বেলালকেও আঘাত করেছে। আমার ভাইকে হত্যা করেছে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিচারক আসামিদের সঠিক সাজা দেন নাই। আদালতের এই রায় আমরা মানি না।
নিহতের আরেক ভাই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মো. বেলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তারা এখন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। যে ১৭ জন সাক্ষী দিয়েছে তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আসামিরা বলে বেড়াচ্ছে তারা ১০ লাখ টাকা দিয়ে বিচারককে কিনেছেন তাই তারা খালাস পেয়েছেন। আমরা আসামিদের ফাঁসি চাই।
নিহতের ভাতিজা মো. মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। আমাকে ঘিরে এই ঘটনাটি ঘটে অথচ প্রধান আসামিরা খালাস পেয়েছে। আমরা রায় শুনে মর্মাহত হয়েছি। বর্তমানে আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। রায় ঘোষণার দিনেও আমাদের এখানে এক বৃদ্ধকে জবাই করে হত্যা করেছে। আমাদের এদিকে হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পায় না। যদি ন্যায়বিচার পাইতো তাহলে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটতো না।
প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মো. আবদুল মুকিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, হত্যা মামলার আসামিরা কীভাবে খালাস পায় তা ভেবে আমরা অবাক। যারা সাক্ষ্য দিয়েছে তারা ভয়ের ভেতর আছে। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।
মামলার ১ নম্বর আসামি আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিহত ইউছুফ আমাকে খুব সম্মান করতো। আমি ১১ বছর সন্তানদের দেওয়া খরচের টাকা আদালতে খরচ করেছি। একদিনও হাজিরা মিস করিনি। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারক আমাদের খালাস দিয়েছেন। আমরা কাউকে হুমকি-ধমকি দেই নাই।
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) মো. এমদাদ হোসেন কৈশোর ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করতে পারছি না। কারণ মামলার প্রধান আসামিরা খালাস পেয়েছে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি বের হলে আমরা পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে যাব।