সরকারের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি না দিয়ে আপাতত ছাত্র আন্দোলনের ওপরই ভরসা রাখছে বিএনপি। শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সমর্থন অব্যাহত রেখে এর যৌক্তিক পরিণতি দেখতে চায় দলটি। সার্বিক পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি বুঝে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এখন ছাত্রছাত্রীরাই মাঠে রয়েছে। আমি মনে করি, এ সরকারের বিরুদ্ধে যা করার ছাত্ররাই করবে। আমাদের কিছু করা লাগবে না। দেখা যাক, পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়ায়?’
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শুরু থেকেই তারা নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। এই আন্দোলন অব্যাহত থাকায় দলীয়ভাবে নতুন কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে দলের হাইকমান্ড পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। তবে এই সময় দলীয় নেতাকর্মীরা যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকবেন।
সেইসঙ্গে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে পেশাজীবী সংগঠনগুলো। গত বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ ধরনের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার এতই ভীতসন্ত্রস্ত এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে যে, তারা নিজেরাই বলছেন, জনগণ এবং সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা শ্রীলঙ্কার মতো গণভবন দখল করে নেবে। সেই ভয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অপব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
সরকারকে অতি দ্রুত পদত্যাগ করে জনতার কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্যাতন যত বৃদ্ধি পাবে গণপ্রতিরোধ ততই দুর্বার হবে।’
বিএনপি নেতারা জানান, ২০১৮ সালেও বিএনপি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল। এবারও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের মাঠের কর্মসূচিতে নামার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে মাঠে ছিলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ১৯ জুলাই মধ্যরাতে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সরকার। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বর্বরভাবে নির্যাতন চালায়। আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় সহিংসতার জন্য এই বিএনপিকে একচেটিয়াভাবে দায়ী করছে সরকার। এরপর শুরু করে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার অভিযান। ব্লক রেইড দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করছে বিএনপিসহ সাধারণ মানুষকেও, যা ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে-পরেও করেনি। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর এবং নাশকতার মামলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশকিছু শীর্ষ নেতাকেও গ্রেপ্তার-পরবর্তী রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রেপ্তারের সংখ্যা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন। কার্যত প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিএনপি নেতাকর্মীরা। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। জেলা পর্যায়েও একই অবস্থা। সব মিলিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামাটা বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ বা পরীক্ষা বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
জানা যায়, গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর আবারও যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি মিত্র দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে দলটি। এসব বৈঠকে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামেনি বিএনপি।
বিএনপির অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘এখন ছাত্রছাত্রীদের যে কর্মসূচি তার বাইরে গিয়ে বিএনপি আপাতত কোনো কর্মসূচি দিবে না। কেননা এখন যে আন্দোলন হচ্ছে সেটি ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এখানে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। বিএনপির রাজনীতিই হলো জনগণের রাজনীতি। জনগণ তো এখন মাঠে নেমেছে। আমরা চাই, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার বিচার ও শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ।’
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভুঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে একটি শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক আন্দোলনে দেশের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গুণীজন, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবাই লড়াইয়ে নেমেছে। কিন্তু সরকারের নজিরবিহীন গুলি-নির্যাতনে ছাত্রসহ আড়াইশর মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমনে বাংলাদেশের সব বাহিনীকে নামানো হয়েছে; কিন্তু আন্দোলন থামেনি। বরং আন্দোলন বাড়ছে এবং আরও তীব্র হবে। দেশের বিবেকবান সব মানুষের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা এবং এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করা।’